আজকের বিষয়:- খারেজ্বীদের উৎপত্তি এবং এর অন্তিম পরিণতি হযরত আলী(রা:) কে হত্যা


পরম করুণাময় ও অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করছি।

আজকের বিষয়:- খারেজ্বীদের উৎপত্তি এবং এর অন্তিম পরিণতি হযরত আলী(রা:) কে হত্যা


হাদীসের সংকলনঃ-খেলাফতে রাশিদা পতনের পেছনের কারণ(৭ম পর্ব)

লেখকঃ-শহীদুল ইসলাম সাজ্জাদ।

সিফফিনের যুদ্ধ চলছে তো চলছেই।সিফফিনের যুদ্ধের এক পর্যায়ে মুয়াবিয়ার দল হেরেই যাবে যাবে এই অবস্থা।এই সময় মুয়াবিয়ার দল কোরআনের আয়াত তীরের বর্শায় বাধলো।কোরআন দেখিয়ে বলল, যুদ্ধ বন্ধ করতে।হযরত আলী(রা:) এর এই নীতি পছন্দ হলো না।উনার ভাবনা হলো ---->>আগে তো বলেই ছিলাম যে আমি ওসমান(রা:) এর হত্যার বিচার করবো।এর জন্য ইসলামের খেলাফতের নীতি অনুযায়ী এর আগে সবাই বায়াত হয়ে আমাকে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে।অথচ মুয়াবিয়া (রা:)আমার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করল।অথচ যখন তাদের হেরে যাওয়ার মতো অবস্থা,তখন তারা যুদ্ধ থামাতে বলছে।তাও আবার কোরআনের আয়াত বর্শায় গেড়েছে।এ আবার কেমন যুদ্ধ থামানো নীতি!
হযরত আলী (রা:) সবাইকে বললেন যে এটা মুয়াবিয়ার (রা:) যুদ্ধের একটা নতুন চাল।কেও থামাবে না।তখন আলী(রা:) এর দলের একটা অংশ বলে উঠল,"হে আলী তুমি কাফের হয়ে গেছো।"এই বলে তারা আলী(রা:) কে পরিত্যাগ করল।
পরবর্তীতে খারেজীদের প্রচন্ড চাপে একটা পর্যায়ে
যুদ্ধকালে সমস্যার সমাধানের লক্ষ্যে দু’জন বিচারক নির্ধারণ করা হয় এই মর্মে যে, তারা দু’জনে মুসলিম উম্মাহর কল্যাণের জন্য যে সিদ্ধান্ত দিবেন তা উভয় পক্ষ মেনে নিবে। আলী (রাঃ)-এর পক্ষ থেকে আবু মূসা আশ‘আরী (রাঃ) এবং মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর পক্ষ থেকে আমর ইবনুল আছ (রাঃ)-কে নির্ধারণ করা হয়। ঘটনাটি ইসলামের ইতিহাসে ‘তাহকীম’ বা সালিস নির্ধারণ নামে পরিচিত।
এই শালিস হতে নির্ধারণ করা হলো যে আলী ও মুয়াবিয়া দুইজন ই তাদের ক্ষমতা হতে ইস্তফা নিবেন।এবং খলিফা নতুন কেও হবেন।দুই পক্ষই এই সিদ্ধান্ত মেনে নিল।
পরিশেষে আলী(রা:) জানিয়ে দিলেন যে ঠিকাছে এমন
হলে আমি খেলাফত থেকে না হয় ইস্তফা নিব।মুসা আল আশয়ারী (রা:) আমর বিন আস(রা:) কে এই কথা জানিয়ে দিলেন।হযরত আমর বিন আস বলে উঠল,"যেহুতু
আলী ক্ষমতা হতে ইস্তফা নিচ্ছেন তাই মুসলিম উম্মাহের নতুন খলিফা হলো মুয়াবিয়া।"
এই বিষয় আলী(রা:) শুনলে তার এই সিদ্ধান্ত গ্রহণে অস্বীকৃতি জানান।কেননা পূর্বের শালিসে কথা ছিল যে মুয়াবিয়া নিজেও ক্ষমতা হতে ইস্তফা নিবেন।আলী(রা:)তার নিজের কথা রেখেছেন।অথচ মুয়াবিয়া ও আমর বিন আস তাদের আগের কথায় নিজেদের কে অটল রাখছেন না।তাদের কথামতো উনারা নতুন কাওকে না বানিয়ে আবার মুয়াবিয়া কেই ক্ষমতা দিতে চাচ্ছে।
এই বিষয় নিয়ে তর্ক বিতর্ক হতে থাকে।পথিমধ্যেই আলী (রাঃ)-এর দল থেকে কিছু লোক বের হয়ে যায়। এরা বলে যে আলী ও মুয়াবিয়া কেও ই কোরআন অনুযায়ী বিচার মানে না।অতএব সবাই কাফের হয়ে গিয়েছে।এরা পরবর্তীতে ‘হারুরা’ নামক প্রান্তরে এসে অবস্থান করে। তাদের মনে আলী(রা:) এর ব্যাপারে অনেক সংশয় কাজ করে।
তাদের সংখ্যা মতান্তরে ৬, ৮, ১২ অথবা ১৬ হাযার হবে। বিচ্ছিন্নতার সংবাদ পেয়ে আলী (রাঃ) দূরদর্শী ছাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ)-কে তাদের নিকট প্রেরণ করেন। তিনি তাদের সংশয়গুলিকে বিচক্ষণতার সাথে খন্ডন করায় বেরিয়ে যাওয়াদের মধ্য থেকে প্রায় ৪ অথবা ৬ হাযার লোক আলী (রাঃ)-এর আনুগত্যে ফিরে আসেন। অতঃপর আলী (রাঃ) কুফার মসজিদে দাঁড়িয়ে ভাষণ দিলে মসজিদের এক কোনায় ‘লা হুকমা ইল্লা লিল্লাহ’ ‘আল্লাহর হুকুম ছাড়া কারো হুকুম মানি না’ স্লোগানে তারা মসজিদ প্রকম্পিত করে তুলে। তারা আলী (রাঃ)-কে উদ্দেশ্য করে বলে যে, আপনি বিচার ব্যবস্থা মানুষের হাতে তুলে দিয়েছেন! অথচ বিচারের মালিক হচ্ছেন আল্লাহ্। আপনি সূরা আন‘আমের ৫৭নং আয়াত (ان الحكم الا لله) ‘আল্লাহ ব্যতীত কারো ফায়ছালা গ্রহণযোগ্য নয়’-এর হুকুম ভঙ্গ করেছেন। আল্লাহর বিধানের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শনের দরুন আপনি কাফের হয়ে গেছেন ইত্যাদি।
তাদের মতে আলী, মু‘আবিয়া, আমর ইবনুল আছ সহ তাহকীমকে সমর্থনকারী সকল ছাহাবী কুফরী করেছেন এবং কাফের হয়ে গেছেন। অথচ সত্য হ’ল, মানুষের ফায়ছালার জন্য মানুষকেই বিচারক হ’তে হবে। আর ফায়ছালা হবে আল্লাহর আইন অনুসারে।
খারেজীরা নিজেদের এই নির্বুদ্ধিতাকে ধর্মীয় গোঁড়ামিতে রূপ দান করে এবং মুসলমানদের মাঝে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের সূচনা করে।
হযরত আলী (রাঃ) তাদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘তোমাদের ব্যাপারে আমরা তিনটি সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
১. তোমাদেরকে মসজিদে আসতে আমরা নিষেধ করব না,
২. রাষ্ট্রীয় সম্পদ হ’তে আমরা তোমাদের বঞ্চিত করব না,
৩. তোমরা আগে ভাগে কিছু না করলে আমরা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব না।
কিছুদিন পর তারা সাধারণ মুসলমানদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করতে শুরু করে। তখন আব্দুল্লাহ বিন খাববাব (রাঃ) রাসূল (صلى الله عليه و آله و سلم) -এর ফিৎনা সংক্রান্ত হাদীছ শুনালে তারা তাঁকে হত্যা করে। তাঁর গর্ভবতী স্ত্রীর পেট ফেড়ে বাচ্চা বের করে ফেলে দেয় এবং দু’টুকরো করে তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করে। হযরত আলী (রাঃ) জিজ্ঞেস করেন, ‘আব্দুল্লাহ্কে কে হত্যা করেছে? জবাবে তারা ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করে বলে, আমরা সবাই মিলে হত্যা করেছি। এরপর হযরত আলী (রাঃ) তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেন। যুদ্ধের আগে তিনি নিজে ইবনু আববাস ও আবু আইয়ূব (রাঃ) সহ তাদের সাথে কয়েক দফা আলোচনা করেন এবং তাদের সংশয়গুলিকে দূর করতঃ সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেন।
খারেজীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার পূর্বে হযরত আলী (রাঃ) তাদের বেরিয়ে যওয়ার কারণগুলি জানতে চাইলে তারা কিছু সংশয় উপস্থাপন করে এবং তিনি প্রত্যেকটির যথার্থ জবাব দেন।(১)
তাদের সংশয়গুলির সংক্ষিপ্ত জবাব নিমণরূপ-
প্রথম সংশয় : উষ্ট্রের যুদ্ধে তাদের জন্য নারী ও শিশুদেরকে যুদ্ধবন্দী ও ক্রীতদাস হিসাবে গ্রহণ করার বৈধতা কেন দেওয়া হয়নি, যেমন দেওয়া হয়েছিল অর্থ-সম্পদের ক্ষেত্রে
জবাব:- হযরত আলী (রাঃ) জবাব দেন কয়েকটি দিক থেকে, (দিকগুলো হলোঃ)
(১) ত্বালহা ও যুবায়র (রাঃ) বায়তুল মাল থেকে যে সামান্য অর্থ নিয়েছিলেন তার বিনিময়ে তাদের জন্য মাল নেয়ার বৈধতা দেওয়া হয়েছিল। তাছাড়াও তা ছিল খুবই সামান্য সম্পদ।
(২) নারী ও শিশুরা তো যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি। তাছাড়াও তারা ইসলামী ভূমিতে বসবাসকারী মুসলিম। তারা মুরতাদ হয়েও যায়নি যে, তাদেরকে ক্রীতদাস হিসাবে গ্রহণ করা জায়েয হবে।
(৩) তিনি তাদেরকে বলেন, ‘আমি যদি নারী ও শিশুদেরকে ক্রীতদাস হিসাবে গ্রহণ করা বৈধ করতাম তাহ’লে তোমাদের মধ্যে কে আছে যে (উম্মুল মুমিনীন) আয়েশা (রাঃ)-কে নিজের অংশে ক্রীতদাস হিসাবে গ্রহণ করার যোগ্যতা রাখ?! তখন নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে তাদের মধ্যে অনেকেই সঠিক পথে ফিরে এসে আলী (রাঃ)-এর আনুগত্য মেনে নেয়।
দ্বিতীয় সংশয় : হযরত আলী (রাঃ) কেন মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর সাথে ছিফ্ফীনের সন্ধি চুক্তি লেখার সময় নিজের নামের প্রথমে ‘আমীরুল মুমিনীন’ কথাটি মুছে ফেলেন এবং তাঁর কথা মেনে নিলেন?
জবাব:-আলী(রা:) জবাব দেন এই বলে যে, ‘আমি তো তাই করেছি যা স্বয়ং রাসূল (صلى الله عليه و آله و سلم) হুদায়বিয়ার সন্ধিতে করেছিলেন। তিনি নিজের নামের প্রথম থেকে ‘রাসূলুল্লাহ’ শব্দটি কাফেরদের দাবী অনুযায়ী মুছে ফেলেন’।(২)
তৃতীয় সংশয় : তিনি হকের পথে থাকার পরেও কেন তাহকীম বা শালিস নিয়োগ করলেন?
জবাব:- এর জবাবে তিনি বলেন, ‘হক্বের পথে থাকার পরেও রাসূল (صلى الله عليه و آله و سلم) বানু কুরায়যা-এর ক্ষেত্রে হযরত সা‘দ বিন মু‘আয (রাঃ)-কে শালিস নিয়োগ করেছিলেন’।
চতুর্থ সংশয় : হযরত আলী (রাঃ) বলেছিলেন, ‘আমি যদি খেলাফতের হকদার হয়ে থাকি, তাহ’লে তারা আমাকে খলীফা নির্বাচন করবে’। খারেজীদের দাবী তিনি নিজের খলীফা হওয়ার যোগ্যতার ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করেছেন।
জবাব:-এর জবাবে তিনি বলেন, ‘এটা ছিল হযরত মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর প্রতি ইনছাফ করা। যেমন রাসূল (সা:) নাজরানের নাছারাদেরকে মুবাহালার জন্য আহবান করেছিলেন তাদের প্রতি ইনছাফ প্রদর্শনের জন্য। এরপর তাদের অনেকেই নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে ফিরে আসে এবং তাঁর আনুগত্য মেনে নেয়।
আর বাকীরা যারা আলী(রা:) এর যথাযথ উত্তর দেয়ার পরেও তারা সন্তুষ্ট হয় নি।বরং আগের মতোই কাফের ফতোয়া দিয়ে সাধারণ মুসলমানদের হত্যা করে যাচ্ছিল;তাদের রুখতে পরিশেষে আলী(রা:) খারেজ্বীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন।ইতিহাসে এই, উদ্ধ নেহেরওয়ান নামে পরিচিত।অর্থাৎ এই পাশে মুয়াবিয়ার সাথে সিফফিনের যুদ্ধে ঘটছে। আবার অপর পাশে খারেজীদের সাথে নেহেরওয়ান যুদ্ধ হচ্ছে।
রাসুল(সা:) খারেজ্বীদের ব্যাপারে ভবিষ্যতবানী করেছিলেন যে তাদর আমল এর তুলনায় তোমাদের আমল তুচ্ছ মনে হবে কিন্তু শীঘ্রই তারা দ্বীন থেকে বেরিয়ে যাবে।তাছাড়া রাসুল (সা:) তাদের শারীরিক বর্ণনা ও দিয়েছেন।
রাসুল সা: বলেছেন তিনি থাকলে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতেন।নবিজী(সা:) এর বলা খারেজ্বীদের শারীরিক বর্ণনা ও চরিত্র এর সাথে নেহেরওয়ান যুদ্ধে আলী(রা:) এর বিপক্ষের খারিজীদের পরিপূর্ণ মিল পাওয়া যায়।এই মিল দেখে সকল সাহাবীরা নিশ্চিত হন যে আলী(রা:) হক্বের উপরে ছিলেন।(৩)
এত অপরাধের পরেও আলী (রা:) খারেজ্বীদেরকে মুসলিম ই মনে করতেন।আলী রা: কে জিজ্ঞাসা করা হলো :- নাহরওয়ানের মানুষ কি মুশরিক ? তিনি জবাব দিলেনঃ তারা তো শির্ক থেকে দৌড়ে পালিয়েছে। অতঃপর তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হলঃ “তারা কি মুনাফিক?” তিনি জবাব দিলেনঃ না! মুনাফিকরা আল্লাহকে সামান্যই স্মরণ করে। তখন তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হলঃ তাহলে তারা কারা? তিনি জবাব দিলেনঃ তারা কেবল আমাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে।(৪)
এই যুদ্ধে খারেজ্বীরা নয় জন ব্যতীত সকলেই নিহত হয়। যুদ্ধ সমাপ্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে খারেজীরা পরাজিত হয় এবং তাদের ফিৎনাও সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায়। বলা হয়, সেদিন বেঁচে যাওয়া নয়জন খারেজীই বিভিন্ন দেশে তাদের বীজ বপন করে।
সেই বেঁচে যাওয়া খারিজীদের একজন ছিল আব্দুর রহমান ইবনে মুলজিম।সে ফজরের সালাতের সময় আলী (রা:) কে ইমামতি করা অবস্থায় মাথায় আঘাত করে।আলী(রা:) দেখলেন উনার দাড়ি রক্তে রঙ্গিন হয়ে গিয়েছে।তখন ই আলী(রা:) বুঝতে পারলেন যে তার জীবন আর অবশিষ্ঠ নেই।উনার মনে পড়ে গেল নবিজী(সা:) এর ভবিষ্যতবানী।একবার রাসুলুল্লাহ (সা:) বলেছিলেন,“আমি কি তোমাদের দুইজনকে সর্বাধিক অভিশপ্ত দুই ব্যক্তির ব্যাপারে জানিয়ে দেব না?” আমরা বললামঃ অবশ্যই! হে আল্লাহর রসূল। তিনি বললেনঃ "ক্বওমে ছামুদের আহমীর নামক ব্যক্তি, যে উটনী হত্যা করেছিল, আর হে আলী! যে ব্যক্তি তোমার মাথায় তরবারি দ্বারা আঘাত করবে এবং তোমার দাড়ি সেই রক্তে রঙ্গিন করবে"।(৫)
উনি বুঝতে পারলেন উনি আর বাঁচবেন না।আঘাত করা হয়েছিল ১৯ শে রমজান।ওনাকে বলা হলো যাতে কোন ওনার পরবর্তী খলিফা নিয়োগ করে যান।কিন্তু উনি রাজতন্ত্র কায়েম করেন নি।উনি বলেছিলেন,"
,না,বরং আমি তোমাদেরকে ওই অবস্থায়ই রেখে যাব, যেই অবস্থায় আল্লাহর রসূল(সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদের রেখে গিয়েছিলেন"।(৬)
অর্থাৎ নবিজী(সা:) জীবিতকালে কোন খলিফা রেখে যান নি।ঠিক একইভাবে আমিও রেখে যাব না। খলিফা যেভাবে নির্বাচিত হয়।সেভাবেই হবে।
আঘাত এর দুই দিন পর ২১ শে রমজান ইসলামের চতুর্থ খলিফা আলী(রা:) নিহত হন।অবসান ঘটে খেলাফতে রাশিদার আমল।
হাদীস --->>>
১)আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস বর্ণনা করেন: "যখন আল হারুরিয়া বেরিয়ে এলো, তারা একটি ঘরে অবসর নিয়েছিল এবং তারা সংখ্যায় ছয় হাজার ছিল সুতরাং আমি 'আলীকে বলেছিলাম: হে আমীরুল মুমিনীন, তাপমাত্রা কমে যাওয়া পর্যন্ত সলাত বিলম্বিত কর, যাতে আমি তাদের সাথে কথা বলতে পারি। আলী ইবনু আবী তালিব বললেনঃ আমি আশঙ্কা করছি যে তারা আপনার ক্ষতি করে দিতে পারে। আমি বললামঃ কখনো না! কোনও সম্ভাবনাই নেই। কাজেই, আমি একটি সুন্দর জামা পরিধান করলাম, চুল আঁচড়ালাম, এবং মধ্যাহ্নে তাদের কাছে উপস্থিত হলাম যখন তারা খাচ্ছিল। তারা বলল, "স্বাগতম! হে ইবনে আব্বাস! কি মনে করে এখানে এলেন?" আমি তাদের বলেছি: “আমি তোমাদের কাছে নবীর সাহাবীদের পক্ষ থেকে এসেছি, সলাত ও শান্তি তাঁর উপর, অভিবাসীদের, সমর্থকদের) এবং নবীর চাচাত ভাইয়ের কাছ থেকে ও তাঁর জামাইয়ের পক্ষ থেকে। তাদের উপর কুরআন নাজিল হয়েছিল। কাজেই, তোমাদের ভেতর এমন কেউ নেই যে তাঁদের চেয়ে কুরআনের ব্যাখ্যা বিষয়ে অধিক জ্ঞান রাখে। আমি তোমাদের কাছে তা-ই বলব, যা তাঁরা বলেছেন, আর তাঁদের কাছে তা-ই বলব, যা তোমরা বল।" এরপর তাদের অনেকে এসে আমার পাশে বসল। আমি তাদের জিজ্ঞাসা করলাম: আপনারা আল্লাহর রসূলের সাহাবী ও তাঁর চাচাত ভাইয়ের বিরুদ্ধে যে বিদ্বেষ পোষণ করছেন, তা কোন দলীলের ভিত্তিতে? তারা বলল: “তিনটি দলীলের ভিত্তিতে”। আমি বললাম; এগুলি কি? তাদের একজন বলেছিলেন: “প্রথম কারণ হল, 'আলী বিচারকের ভূমিকায় নিয়েছেন, অথচ বিচারের মালিক আল্লাহ্ নিজে, কেননা আল্লাহ্ বলেনঃ "বিচারের হক তো কেবল আল্লাহ্ই (আনআম ৬:৫৭। মানুষের আবার বিচারের সাথে লেন-দেন কিসের?” আমি বললামঃ এটি তাহলে একটি অভিযোগ। তারা বললঃ দ্বিতীয় কারণ হল, সে লড়াই করেছে, কিন্তু সে বন্দী করেনি এবং গনীমতও ভোগ করতে পারেনি। যদি তারা কাফের হয়, তবে তাদের বন্দী করা তো বৈধ আর যদি তারা ঈমানদার হয় তবে তাদের সাথে লড়াই করা তো প্রথমেই জায়েয ছিল না। আমি বললামঃ দু'টি অভিযোগ গেল, তৃতীয়টি কী? তারা বললঃ তিনি ঈমানদারদের 'সেনাপতি' শব্দটি থেকে নিজের নাম থেকে মুছে ফেলে দিয়েছিলেন। যদি সে ঈমানদারদের সেনাপতি না হয় তবে সে কি অবিশ্বাসীদের সর্বাধিনায়ক? "আমি বললামঃ এর বাইরেও আপনার কি কিছু আছে? তারা বলল: “না! এই তিনটিই যথেষ্ট”। আমি বললামঃ আমি যদি আল্লাহর কিতাব, আল্লাহর রসূলের সুন্নাহ থেকে পড়ে শোনাই এবং তোমাদের অভিযোগসমূহের খন্ডন করি, তোমরা কি মেনে নেবে? তারা বলেছিল: “হ্যাঁ! অবশ্যই"।
আমি বললাম: তোমরা অভিযোগ করছ আলীর বিরুদ্ধে যে তিনি মানুষ হয়েও বিচারকার্য করছেন, অথচ তা আল্লাহর কাজ। আমি তোমাদেরকে আল্লাহ্র কিতাব থেকে দেখাব, যেখানে আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা'আলা মানুষের ওপর ১/৪ দিরহামের মূল্যের ব্যাপারে সিদ্ধান্তের দায়িত্ব অর্পণ করেছেন। তোমরা কি আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা'আলার এই আয়াত দেখনি? : “হে ইমানদারগণ! তোমরা ইহরাম বাধা অবস্থায় শিকার কর না। তোমাদের ভেতর যারা এই কাজ জেনে-শুনে করবে, তার বিনিময় হবে ঐ জন্তুর অনুরূপ, যা সে বধ করেছে। দু'জন নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি তার বিচার করবে [মাইদা ৫:৯৫]'। লক্ষ্য করে দেখো, মহান আল্লাহ্ এই সামান্য ও ছোট্ট একটি বিচারের যথাযথ সমাধানের ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তার বান্দাদের ওপর বিচারের দায়িত্ব অর্পণ করলেন। আমি আল্লাহর নামে তোমাদের জিজ্ঞাসা করছিঃ মুসলিমদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দের মীমাংসা, শান্তির উদ্দেশ্যে রক্তপাত বন্ধ করা কি বেশি গুরুত্বপূর্ণ নাকি খরগোশ হত্যার মামলা অধিক গুরুত্বপূর্ণ? তারা জবাব দিলঃ “কেন নয়! এটিই অধিক গুরুত্বপূর্ণ"। "মহান আল্লাহ্ স্বামী-স্ত্রীর ব্যাপারে বলেনঃ যদি তোমরা দুইয়ের মাঝে ফাটলের আশংকা কর, তাহলে তাঁর (স্বামী) পক্ষ থেকে একজন বিচারক ও তার (স্ত্রী) পক্ষ থেকে একজন বিচারক নিযুক্ত কর। [নিসা ৪:৩৫]। আমি আল্লাহর নামে তোমাদের জিজ্ঞাসা করছিঃ মুসলিমদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দের মীমাংসা, শান্তির উদ্দেশ্যে রক্তপাত বন্ধ করা কি বেশি গুরুত্বপূর্ণ নাকি স্বামী-স্ত্রীর বৈবাহিক মামলা অধিক গুরুত্বপূর্ণ?" তারা জবাব দিলঃ “ঠিক আছে”। অতঃপর, আমি বললামঃ তোমরা অভিযোগ করছ তিনি যুদ্ধ করেছেন অথচ বন্দী এবং গণিমতের মাল গ্রহণ করেন নি। তোমরাই বল, তোমরা কি তোমাদের মা, মুমিন জাতির মা "আইশাহ্ কে যুদ্ধবন্দী হিসেবে নেবে? যদি তোমাদের জবাব হ্যাঁ হয়, তাহলে তোমরা অন্য নারীদের মতই তাঁকে হালাল করে নিলে। সেক্ষেত্রে তোমরা কুফর করে ফেললে। আর, যদি তোমরা বল যে তিনি তোমাদের মা নন, তাহলেও তোমরা কুফর করলে, কেননা মহান আল্লাহ্ বলেনঃ "নবী মুমিনদের নিকট তাঁদের নিজেদের অপেক্ষা অধিক অন্তরঙ্গ এবং নবীদের স্ত্রীগণ তাদের মা [আহযাব ৩৩:৬] সুতরাং, তোমরা দুইটি বিভ্রান্তি গ্রহণ করেছ। এই বিভ্রান্তি থেকে বের হয়ে আসো। তোমরা কি দ্বিতীয় প্রশ্নের জবাব পেয়েছো? তারা জবাব দিলঃ হ্যাঁ। তখন আমি জিজ্ঞাসা করলামঃ তোমরা অভিযোগ করছ তিনি আমীরুল মুমিনীন' শব্দটি মুছে দিয়েছেন। সেক্ষেত্রে আমই তোমাদের জবাব দেব, যা তোমাদের মন শান্ত করবে। খেয়াল করা আল্লাহর রসূল (সাল্লালাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হুদাইবিয়ার সন্ধিতে 'মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ্' লিখান। কাফেররা প্রশ্ন তোলে যে আমাদের যুদ্ধের কারণই হল যে আমরা আপনাকে রসূল মানি না। তাই তিনি 'আলীকে বললেন, হে “আলী! লেখঃ 'মুহাম্মাদ বিন 'আব্দিল্লাহ্'... (৪৫)। আল্লাহ্র কসম! আল্লাহ্র রসূল (সাল্লালাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম) "আলীর চেয়ে অনেক উত্তম এবং তিনি তাঁর নাম থেকে 'আল্লাহর রসূল' মুছিয়ে দিয়েছিলেন। এই মুছে দেয়ার কারণে তাঁর রিসালাত মুছে যায় নি। তোমরা কি তৃতীয় প্রশ্নের জবাব পেয়েছ? তারা জবাব দিলঃ হ্যাঁ । এরপর, তাদের ভেতর ২০০০ জন তৎক্ষণাৎ প্রত্যাবর্তন করে, আর বাকি ৪০০০ খারিজী তাদের পথভ্রষ্টতার কারণে মুহাজিরীন ও আনসারদের দ্বারা হত্যা হয়েছিল [সুনানুন নাসাঈ আল কুবরাঃ ৮৫৭৫ (৮৫২২), শায়খ গোলাম মোস্তফা জহীর খাছায়েছে আলী তে হাদিসটিকে সহীহ বলেছেন]
২)হুদায়বিয়ার সন্ধির সময়ের হাদীস:--->>
বারাআ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, নবী (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যিলকা'দা মাসে 'উমরাহ্ আদায়ের উদ্দেশ্যে রওয়ানা করেন। মক্কাবাসীরা তাঁকে মক্কায় প্রবেশের অনুমতি দিতে অস্বীকৃতি জানাল। অবশেষে তাদের সঙ্গে চুক্তি হল যে, (আগামী বছর উমরাহ্ পালন হেতু) তিনি তিনদিন মক্কায় অবস্থান। করবেন। মুসলিমগণ সন্ধিপত্র লেখার সময় এভাবে লিখেছিলেন, আল্লাহর রসূল মুহাম্মদ আমাদের সঙ্গে এ চুক্তি সম্পাদন করেছেন। ফলে তারা (মক্কার কুরাইশরা) বলল, আমরা তো এ কথা স্বীকার করিনি। যদি আমরা আপনাকে আল্লাহ্র রসূল বলেই জানতাম তা হলে মাক্কাহ প্রবেশে মোটেই বাধা দিতাম না। বরং আপনি তো মুহাম্মদ ইবনু 'আবদুল্লাহ। তখন তিনি বললেন, আমি আল্লাহর রসূল এবং মুহাম্মদ ইবনু 'আবদুল্লাহ। তারপর তিনি 'আলী (রাঃ)-কে বললেন, রসূলুল্লাহ শব্দটি মুছে ফেল। 'আলী (রাঃ) উত্তর করলেন, আল্লাহর কসম! আমি কখনো এ কথা মুছতে পারব না। রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তখন চুক্তিপত্রটি হাতে নিলেন। তিনি লিখতে জানতেন না, তবুও তিনি লিখে দিলেন যে, মুহাম্মদ ইবনু 'আবদুল্লাহ এ চুক্তিপত্র সম্পাদন করলেন যে, তিনি কোষবদ্ধ তরবারি ব্যতীত অন্য কোন অস্ত্র নিয়ে মক্কায় প্রবেশ করবেন না। মক্কাবাসীদের কেউ তাঁর সঙ্গে যেতে চাইলেও তিনি তাকে বের করে নিয়ে যাবেন না। তাঁর সাথীদের কেউ মক্কায় থেকে যেতে চাইলে তিনি তাকে বাধা দিবেন না। (পরবর্তী বছর) যখন রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মক্কায় প্রবেশ করলেন এবং নির্দিষ্ট সময় অতিক্রান্ত হল তখন মুশরিকরা "আলীর কাছে এসে বলল, আপনার সাথী [রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম)]-কে বলুন যে, নির্ধারিত সময় পেরিয়ে গেছে। তাই তিনি যেন আমাদের নিকট থেকে চলে যান। নবী (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সে মতে বেরিয়ে আসলেন। এ সময় হামযাহ (রাঃ)-এর কন্যা চাচা চাচা বলে ডাকতে ডাকতে তাঁর পেছনে ছুটল। 'আলী (রাঃ) তার হাত ধরে। তুলে নিয়ে ফাতেমাহ (রাঃ)-কে দিয়ে বললেন, তোমার চাচার কন্যাকে নাও। ফাতেমাহ (রাঃ) বাচ্চাটিকে উঠিয়ে নিলেন। (মদিনায় পৌঁছলে) বাচ্চাটি নিয়ে 'আলী, যায়দ (ইবনু হারিসাহ) ও জা'ফার [ইবনু আবূ ত্বলিব (রাঃ)]- এর মধ্যে ঝগড়া বেধে গেল। 'আলী (রাঃ) বললেন, আমি তাকে তুলে নিয়েছি আর সে আমার চাচার মেয়ে। জাফর বললেন, সে আমার চাচার মেয়ে আর তার খালা হল আমার স্ত্রী। যায়দ [ইবনু হারিসা (রাঃ)] বললেন, সে আমার ভাইয়ের মেয়ে। তখন নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মেয়েটিকে তার খালার জন্য ফায়সালা দিয়ে বললেন খালা তো মায়ের মর্যাদার। এরপর তিনি আলীকে বললেন, তুমি আমার এবং আমি তোমার। জাফর (রাঃ)-কে বললেন, তুমি আকৃতি-প্রকৃতিতে আমার মতো। আর যায়িদ (রাঃ)-কে বললেন, তুমি আমাদের ভাই ও আযাদকৃত গোলাম। 'আলী (রাঃ) [নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে] বললেন, আপনি হামযাহ'র মেয়েটিকে বিয়ে করছেন না কেন? তিনি [নবী (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম)] বললেন, সে আমার দুধ ভাই-এর মেয়ে।
তিরমিজীর বর্ণনায়ঃ ইমরান ইবনু হুসাইন (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এক সামরিক বাহিনী পাঠানোর সময় আলী ইবনু আবী ত্বালিব (রাঃ)-কে তাদের সেনাপতি নিযুক্ত করেন। তিনি সেনাদলের একটি খণ্ডাংশের (সারিয়্যা) পরিদর্শনে যান এবং এক যুদ্ধবন্দিনীর সঙ্গে মিলিত হন। কিন্তু তার সাথীরা তার এ কাজ পছন্দ করলেন না। অতএব রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর চারজন সাহাবী শপথ করে বললেন, যখন আমরা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু "আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর দেখা পাব, তাঁকে তখন 'আলীর কার্যকলাপ প্রসঙ্গে জানাব। মুসলিমদের নিয়ম ছিল। যে, তারা কোন সফর বা অভিযান শেষে ফিরে এসে সর্বপ্রথম রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁকে সালাম করতেন, তারপর নিজ নিজ গৃহে ফিরে যেতেন। সুতরাং উক্ত সেনাদল ফিরে এসে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে সালাম জানায় এবং চার সাহাবীর একজন দাঁড়িয়ে বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! লক্ষ্য করুন, 'আলী ইবনু আবী তালিব এই এই করেছেন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু "আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার দিক হতে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। তারপর দ্বিতীয় ব্যক্তি দাঁড়িয়ে পূর্বোক্ত ব্যক্তির মতো বক্তব্য পেশ করেন এবং রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার হতেও মুখ ফিরিয়ে নিলেন। এবার তৃতীয়জন দাঁড়িয়ে পূর্বোক্তজনের একই রকম বক্তব্য পেশ করেন এবং রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার হতেও মুখ ফিরিয়ে নেন। অবশেষে চতুর্থজন দাঁড়িয়ে পূর্বোক্তদের একই রকম বক্তব্য পেশ
করেন। এবার রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার চেহারায় অসন্তুষ্টির ভাব নিয়ে তাদের দিকে মনোনিবেশ করে বললেন "তোমরা আলী প্রসঙ্গে কি বলতে চাও? "(বংশ, বৈবাহিক সম্পর্ক, অগ্রগণ্যতা, ভালবাসা ইত্যাদি প্রসঙ্গে) আলী আমার হতে এবং আমি 'আলী (রাঃ) হতে। আমার পরে সে-ই হবে সমস্ত মু'মিনের সঙ্গী ও পৃষ্ঠপোষক। [সহিহ বুখারী: ৪২৫১, জামে' আত-তিরমিজি: ৩৭১২]
৩)আবূ সা'ঈদ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, নবী (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কোন কিছু বণ্টন করছিলেন। ঘটনাক্রমে 'আবদুল্লাহ্ ইবনু যুলখুওয়ায়সিরা তামীমী এল এবং বলল, হে আল্লাহ রসূল! ইনসাফ করুন। তিনি বললেন: আফসোস তোমার জন্য! আমি যদি ইনসাফ না করি তা হলে আর কে ইনসাফ করবে? "উমর ইবনু খাত্তাব (রাঃ) বললেন, আমাকে অনুমতি দিন, তার গর্দান উড়িয়ে দেই। তিনি বললেনঃ তাকে। ছেড়ে দাও। তার জন্য সাথীরা আছে। যাদের সালাতের তুলনায় তোমরা তোমাদের সালাতকে তুচ্ছ মনে করবে। যাদের সিয়ামের তুলনায় তোমরা তোমাদের সিয়ামকে তুচ্ছ মনে করবে। তারা দ্বীন থেকে এমনিভাবে বেরিয়ে যাবে যেমন তার শিকার ভেদ করে বেরিয়ে যায়। তীরের প্রতি লক্ষ্য করলে তাতে কিছু পাওয়া যায় না। তীরের মুখের বেষ্টনীর প্রতি লক্ষ্য করলেও কিছু পাওয়া যায় না। তীরের কাঠের অংশের দিকে দেখলেও তাতে কিছু পাওয়া যায় না। বরং তাঁর তীব্র গতিতে বেরিয়ে যাবার সময় তাতে মল ও রক্তের দাগ পর্যন্ত লাগে না। তাদের পরিচয় এই যে, তাদের একটি লোকের একটি হাত অথবা বলেছেন, একটি স্তন হবে মহিলাদের স্তনের ন্যায়। অথবা বলেছেন, অতিরিক্ত গোশতের টুকরার ন্যায়। লোকদের মধ্যে বিরোধের সময় তাদের আবির্ভাব ঘটবে। আবূ সা'ঈদ (রাঃ) বলেন, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আমি তা নবী (সাল্লালাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে শুনেছি। এও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আলী (রাঃ) তাদেরকে হত্যা করেছেন। আমি তখন তাঁর সঙ্গে ছিলাম। তখন নবী (সাল্লালাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর দেয়া বর্ণনার সংগে মিলে এমন ব্যক্তিকে আনা হয়েছিল। তিনি বলেন, ওর সম্পর্কেই অবতীর্ণ হয়েছেঃ “ওদের মধ্যে এমন লোক আছে যে সদকা সম্পর্কে তোমাকে দোষারোপ করে”- (সূরা আত্-তওবা ৯/৫৮) [সহিহ বুখারী: ৬৯৩৩, সহীহ মুসলিম ২৪৫৬]
৪)তারিক বিন শিহাব বর্ণনা করেনঃ আমি 'আলীর সাথে ছিলাম। তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হলঃ নাহরওয়ানের মানুষ কি মুশরিক ? তিনি জবাব দিলেনঃ তারা তো শির্ক থেকে দৌড়ে পালিয়েছে। অতঃপর তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হলঃ “তারা কি মুনাফিক?” তিনি জবাব দিলেনঃ না! মুনাফিকরা আল্লাহকে সামান্যই স্মরণ করে। তখন তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হলঃ তাহলে তারা কারা? তিনি জবাব দিলেনঃ তারা কেবল আমাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে। সুনানুল কুবরা লিল বায়হাকীর বর্ণনায়ঃ নাফে' বর্ণনা করেনঃ “আব্দুল্লাহ বিন উমার খাশবিয়্যাহ্ ও খারেজীদেরকেও সালাম করতেন, যারা কিনা যুদ্ধ করত। তিনি বলতেনঃ “যে বলবে, সলাতের দিকে আসো, আমি তার আহ্বানে সাড়া দেব। যে বলবে, কল্যাণের দিকে এসো, আমি তার আহ্বানেও সাড়া দেব। কিন্তু, কেউ যদি মুসলিম ভাইদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ও তাদের সম্পদ লুণ্ঠনের আহ্বান করে, আমি তার আহ্বানে সাড়া দেব না”। [মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বাঃ ৩৭৯৪২, সহীহ, সুনানুল কুবরা লিল বায়হাকীঃ ৫০৮৮, শায়খ যুবায়ের 'আলী যাঈ মাকালাত-১ এ সনদটিকে সহীহ বলেছেন]
৫)“আম্মার বিন ইয়াসির (রা) বর্ণনা করেনঃ আমি যিল 'আশীরাহ যুদ্ধে 'আলী (রা) বিন আবী তালিবের সঙ্গী ছিলাম। আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সেখানে এসে অবস্থান করলেন। এমতাবস্থায় আমরা বানী মাদলিজের কিছু লোককে দেখতে পেলাম, যারা খেজুর বাগানে কাজ করছিলেন। কাজেই, 'আলী এবং আমি সেখানে গেলাম এবং কিছুক্ষণ তাদেরকে কাজ করতে দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে পড়লাম। তারপর, আমাদের ঘুম পেয়ে গেল এবং আমরা ছোট খেজুরের গাছের নিচে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। আমাদেরকে জাগিয়ে তুললেন স্বয়ং আল্লাহ রসূল (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার পায়ের আওয়াজ দিয়ে আর আমরা ধুলামলিন হয়ে উঠলাম। আল্লাহ্র রসূল (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ হে আবু তুরাব! ঘুম থেকে ওঠো! অতঃপর তিনি প্রশ্ন করলেনঃ “আমি কি তোমাদের দুইজনকে সর্বাধিক অভিশপ্ত দুই ব্যক্তির ব্যাপারে জানিয়ে দেব না?” আমরা বললামঃ অবশ্যই! হে আল্লাহর রসূল। তিনি বললেনঃ "ক্বওমে ছামুদের আহমীর নামক ব্যক্তি, যে উটনী হত্যা করেছিল, আর হে আলী! যে ব্যক্তি তোমার মাথায় তরবারি দ্বারা আঘাত করবে এবং তোমার দাড়ি সেই রক্তে রঙ্গিন করবে"। [আল মুসতাদরাক লিক হাকিমঃ ৪৬৭৯, ইমাম হাকিম ও যাহাবী বলেনঃ সনদটি মুসলিমের শর্তানুযায়ী সহীহ, আস সিলসিলাতুস সহীহাহঃ ১৭৪৩, সুনানুন নাসাঈ আল কুবরাঃ ৮৫৩৮, শায়খ গোলাম মোস্তফা জহীর খাছায়েছে আলী তে হাদিসটিকে সহীহ বলেছেন]
৬)আবূ যর গিফারী বর্ণনা করেন, আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন: "সর্বপ্রথম আমার সুন্নাহ পরিবর্তনকারী ব্যক্তি বনু উমাইয়্যা থেকে হবে"। শায়খ আলবানী তার মাজমু'আহ তে এই হাদিসের ব্যাপারে বলেনঃ “এই হাদিসে পরিবর্তনের অর্থ হল খিলাফাহকে রাজতন্ত্রে পরিবর্তন করে দেয়া"। মুসনাদ আবী ইয়ালা, বাযযার ও মাজমাউয যাওয়ায়েদের বর্ণনায়ঃ 'আব্দুল্লাহ বিন সাই বর্ণনা করেন, আলী ইবনু আবী তালিব এক বক্তৃতায় আমাদের বললেনঃ “সেই আল্লাহ্র কসম, যিনি দানা থেকে তার সৃষ্টি উদগত করেন, এমন এক সময় আসবে যখন আমার দাড়ি রঙিন হবে আমার মাথার রক্তে"। এক ব্যক্তি দাড়িয়ে বললঃ আল্লাহর কসম! যে ব্যক্তি এই কাজ করবে, আমরা তাকে পরিবার সহ ধ্বংস করে দেব। তিনি বললেনঃ “আমি তোমাদেরকে এই ব্যাপারে আল্লাহর ভয় প্রদর্শন করছি, এ কাজ কর না। কেবলমাত্র আমার হত্যাকারী ব্যতীত কাউকে হত্যা কর না”। সেই ব্যক্তি বললওঃ হে আমীরুল মুমিনীন! আপনি আপনার খলীফা নিযুক্ত করে যান। তিনি উত্তর করলেনঃ “না, বরং আমি তোমাদেরকে ওই অবস্থায়ই রেখে যাব, যেই অবস্থায় আল্লাহর রসূল(সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদের রেখে গিয়েছিলেন"। লোকজন বলা শুরু করলঃ আপনি যদি আপনার খলীফা নিযুক্ত করে না রেখে যান, তাহলে আপনি আল্লাহর সাথে সাক্ষাত কীভাবে করবেন? 'আলী বললেনঃ “আমি বলব, হে আল্লাহ্! আমি তাদের মাঝে ছিলাম যতদিন আপনি আমাকে তাদের মাঝে রেখেছিলেন আর যখন আপনি আমাকে মৃত্যু দান করলেন, আমি আপনাকে তাদের দেখভালের জন্য রেখে দিলাম। এখন, এটি আপনার ওপর যে, আপনি তাদেরকে একত্রিত করবেন নাকি ধ্বংস করবেন" [আল আওয়ায়েল ইবনু আবী আসিমঃ ৬১, সিলসিলা সহীহাহঃ ১৭৪৯, মুসনাদ আবী ইয়া'লাঃ ৫৯০, মাজমাউয যাওয়ায়েদঃ ১৪৭৮২, ইমাম হায়ছামী ও শায়খ হুসাইন সালীম হাদিসটিকে সহীহ বলেছেন]

Comments

Popular posts from this blog

সিফফিনের যুদ্ধ।

আহলে বায়াতের মর্যাদা