১২ ইমাম নিয়ে শিয়া ও সুন্নীদের রায়।(১ম পর্ব)





 পরম করুণাময় ও অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করছি।

বিষয়:- ১২ ইমাম নিয়ে শিয়া ও সুন্নীদের রায়।(১ম পর্ব)


লেখক:- শহীদুল ইসলাম সাজ্জাদ।


আল্লাহ তা'য়ালা যুগে যুগে নবী রাসুল প্রেরণ করেন।প্রত্যেক যুগে আল্লাহ তা'য়ালা আমাদের শেষ নবী আসবে তা আগের নবীদেরকে জানিয়ে দিয়ে যান।আল্লাহ তা'য়ালা আসমানি গ্রন্থ আগেও নাযিল করেছিলেন যা যুগের প্ররিপ্রেক্ষিতে বিকৃত হয়ে যায়।আজকে যেই বাইবেল দেখতে পাই তা আগে পুরাতন নিয়মটি তাওরাত ছিল।যা মানুষ বিকৃত করে ফেলে।এর মধ্যে নানা কিছু সংযোজন ও বিয়োজন হয়।কিন্তু যেহতু এই গ্রন্থগুলো একদা আল্লাহর বানী ছিল তাই এর মধ্যে এখনো কিছু সত্য কথা রয়ে গিয়েছে।রয়ে গিয়েছে অনেকগুলো ভবিষ্যতবানী যা আল্লাহ বলে দিয়েছেন।


ইম্মায়েল সম্পর্কে তোমার নিবেদনও আমি গ্রাহ্য করলাম। আমি তাকেও আশীর্বাদ করব। তাকে আমি প্রজাবন্ত করব, তার বংশকে করব বহুগুণে বর্ধিত। তার বংশে বারোজন গোষ্ঠীপতি উৎপন্ন হবে এবং আমি তাকে এক বিরাট জাতিতে পরিণত করব।আদিপুস্তক 

(বাইবেল, আদিপুস্তক 17:20)


বাইবেলের আরেক ভার্সন:-

“তুমি ইশ্মাযেলের কথা বলেছ এবং আমি সে কথা শুনেছি| আমি তাকে(ইস্মায়েলকে)আশীর্বাদ করব| তার(ইস্মায়েলের) বহু সন্তানসন্ততি হবে| সে(ইস্মায়েল) বারোজন মহান নেতার পিতা হবে| তার (ইস্মায়েলের) পরিবার থেকে সৃষ্টি হবে এক মহান জাতির|” (বাইবেল,আদিপুস্তক ১৭:২০)


এখানে এর দ্বারা বোঝা যাচ্ছে যে ইসমাইল(আ:) আল্লাহ এমন এক আশীর্বাদ দিয়েছেন যার ফলে ওনার বংশ মহান হবে।তার বংশে মহান ১২ নেতার জন্ম হবে। তাহলে এই ১২ নেতা কারা?এর উত্তর ই আছে ইসলামের মধ্যে।


আমরা জানি যে ইসমাইল(আ:) ও বিবি হাজেরা কে আল্লাহর ইচ্ছায় ইব্রাহিম (আ:)  এক মরুভূমিতে রেখে আসেন।সেই মরুভুমিতে বিবি হাজেরা দৌড়াদৌড়ি করেন  আর ইসমাইল আ: এর পায়ের ঘসায় কুদরতিভাবে জমজম কুপের উৎপত্তি হয়।তখন থেকে এই এলাকায় মানুষ বসবাস গড়ে ওঠে।সেই এলাকার নাম ই হলো মক্কা।আর ইসমাইল আ: এর বংশেই জন্মগ্রহণ করেন আমাদের নবী মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ(সা:)।তাহলে নিশ্চয়ই আল্লাহর নবী ১২ ইমামের ব্যাপারে বলেছেন? উত্তর হলো অবশ্যই!


নবিজীর বলা হাদীসটি পড়ুন:-


১)আমি নবী (ﷺ) কে বলতে শুনেছি, "বারোজন মুসলিম শাসক হবে ।" তিনি তখন একটি বাক্য বললেন যা আমি শুনিনি। আমার পিতা বললেন, "তারা (ওই শাসক) সবাই কুরাইশ হবে।" (সহীহ আল-বুখারী 7222, 7223)


আরেকটি হাদীস পড়ুন:-


২)আমীর থেকে বর্ণিত হয়েছে। সা'দ খ. আবু ওয়াক্কাস বলেনঃ আমি জাবিরকে (একটি চিঠি) লিখেছিলাম। সামুরা (রাঃ) এবং আমার দাস নাফি'র মাধ্যমে তাঁর কাছে এটি পাঠিয়েছিলেন, তিনি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছ থেকে শুনেছেন এমন কিছু আমাকে জানাতে বললেন (তিনি আমাকে লিখেছেন (উত্তরে) : আমি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে শুনেছি। আল্লাহ (ব্যভিচারের অপরাধে) যেদিন আল-আসলামীকে পাথর ছুড়ে হত্যা করা হয়েছিল, শুক্রবার সন্ধ্যায় বলবেন: ইসলাম ধর্ম কেয়ামত পর্যন্ত চলবে।তিনি আমাকে লিখলেন (উত্তরে) : আমি রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলতে শুনেছি (যেদিন শুক্রবার সন্ধ্যায় আল আসলামীকে (ব্যভিচারের অপরাধে) পাথর মেরে হত্যা করা হয়েছিল: ইসলাম ধর্ম চলবে যতক্ষণ না কেয়ামত প্রতিষ্ঠিত হয়, অথবা আপনি বারোজন খলিফা দ্বারা শাসিত হন, তাদের সকলেই কুরাইশদের থেকে তাকে বলতে শুনেছেন: মুসলমানদের একটি ছোট বাহিনী সাদা প্রাসাদ দখল করবে, এর পুলিশ পারস্যের সম্রাট বা তার বংশধরদেরকেও বলতে শুনেছি: কিয়ামতের আগে (অনেক) প্রতারকদের আবির্ভাব হবে, আমি তাকে বলতে শুনেছি: যখন আল্লাহ তোমাদের কাউকে সম্পদ দেন। তিনি প্রথমে এটি নিজের এবং তার পরিবারের জন্য ব্যয় করবেন (অতঃপর এটি গরীবদেরকে দান করুন) আমি তাকে (এছাড়াও) বলতে শুনেছি: আমি আপনার আগমনের জন্য অগ্রদূত হব। (সহীহ মুসলিম হাদীস নং 4711)


হাদীসগুলো পড়ে আমরা কি বুঝলাম?আমরা বুঝলাম যে রাসুল(সা:) বলেছেন আমার পরে ১২ জন শাসক ইমাম হবে যা কুরাইশ থেকে হবে।


সুতরাং এই ১২ জন ইমাম কারা? এ নিয়ে শিয়া ও সুন্নীদের মধ্যে রয়েছে দ্বন্দ।প্রথমে আমি আহলে তাশায়ু(শিয়াদের) রায় উল্লেখ করব এবং পরে কেন আহলে সুন্নাহ(সুন্নী) একমত নয় এবং সুন্নীদের এই ব্যাপারে রায় কি তা ইল্লেখ করব।


আহলে তাশায়্যু(শিয়া) দৃষ্টিতে ১২ ইমাম :-নবিজী (সা:) বিদায় হজ্বের ভাষনে  গাদিরে খুম নামক স্থানে আলী(রা:) এর হাতে হাত রেখে উচু করে বলেন আমি যার অভিভাবক(মাওলা) আলীও তার অভিভাবক।এখানে এর দ্বারা ওনারা(শিয়ারা) বুঝে থাকেন যে আলী রা: ই হলো নবিজীর রেখে যাওয়া প্রতিনিধি।উনিই এখন খেলাফতের হকদার।আর তাছাড়া নবিজী যেহুতু বলেছিলেন যে আমার বংশ থেকে মাহদি আসবে যে বিশ্ব শাসন করবে তাই সেই ইমাম মাহদি হলো শেষ ১২ ইমাম।এখানে উল্লেখ্য আলী রা: হতে ১১ প্রজন্ম এসে পড়েছে যাদেরকে শাসকগণ হত্যা করে।ওনাদের যে হত্যা করা হয় তা শিয়া ও সুন্নী দুই সোর্স এই প্রমাণিত।তবে ১২ ইমামকে(ইমাম মাহদি) যাতে কেও হত্যা করতে না পারে এজন্য আল্লাহ তাকে তুলে নেন।কিয়ামতের আগে উনি আবার আসবেন।তবে সুন্নীদের মত ভিন্ন।সুন্নীদের মতে ইমাম মাহদি ভবিষ্যতে জন্ম নেবেন।


শিয়াদের ১২ ইমাম নিম্নে দেয়া হলো:-


১২ জন ইমাম হলেন –


১। ইমাম আলী ইবনে আবু তালিব 

২। ইমাম হাসান ইবনে আলী 

৩। ইমাম হুসাইন ইবনে আলী 

৪। ইমাম জয়নাল আবেদিন 

৫। ইমাম মুহাম্মাদ আল বাকের 

৬। ইমাম জাফর সাদেক 

৭। ইমাম মুসা আল কাজিম 

৮। ইমাম আলী রেজা 

৯। ইমাম মুহাম্মাদ আল তাক্বি 

১০। ইমাম আলী আন নাক্বি 

১১। ইমাম হাসান আল আসকারি 

১২। ইমাম মুহাম্মাদ আল মাহদি


তারা মনে করেন যে সেই ১২ ইমামগণ রাসুল(সা:) এর বংশধর হতেই আসবেন।তাই ওনাদেরকেই  আল্লাহ মনোনিত ইমাম মানেন।তারা কোন যুক্তিতে ওনাদেরকে নবিজীর বলা সেই ১২ ইমাম মানে। যদি আমি ২য় পর্ব লিখি তবে  সেই পর্ব তে আলোচনা হবে।সেখানে আমি শিয়া গ্রন্থের রেফারেন্স নিয়ে আসব।


এখানে যেই ১২ ইমামের কথা বললাম সেই ইমামগণকে সুন্নী ইসলাম নেককার ও পরহেজগার ব্যক্তি হিসেবে অত্যন্ত সম্মান করেন।আমরা ভালোভাবেই জানি যে সুন্নী ইসলামে মাঝহাবের ইমাম আবু হানিফা রহ: ও ইমাম মালেক রহ  ইমাম জাফর সাদিকের ছাত্র ছিলেন।যাকে কিনা শিয়ারা ৬ষ্ঠ ইমাম মানে।


তবে সুন্নীদের রায় হলো ওনারা মহান লোক সেটি ঠিক। কিন্তু  ওনাদেরকে আল্লাহ মনোনিত সেই ১২ইমাম মনে করেন না।কারণ ওনাদের হাতে খেলাফত আসে নি(হযরত আলী(রা:) ও হাসান (রা:)  ব্যতিত)।এখন দেখা যাক আহলে সুন্নাত  ওয়াল জামা'আত (সুন্নী ইসলাম) এই ব্যাপারে কি বলে।


-----------------------------


আহলে সুন্নাত(সুন্নী) দৃষ্টিতে ১২ ইমাম:-


আগে কোরআনের এই আয়াতটি পড়ুন:-


তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান আনে ও সৎ কাজ করে আল্লাহ তাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন যে, তিনি তাদেরকে পৃথিবীতে প্রতিনিধিত্ব দান করবেনই, যেমন তিনি প্রতিনিধিত্ব দান করেছিলেন তাদের পূর্ববর্তীদেরকে এবং তিনি অবশ্যই তাদের জন্য সুদৃঢ় করবেন তাদের দীনকে যা তিনি তাদের জন্য মনোনীত করেছেন এবং তাদের ভয় ভীতির পরিবর্তে তাদেরকে অবশ্যই নিরাপত্তা দান করবেন; তারা আমার ইবাদাত করবে, আমার সাথে কোন শরীক করবেনা, অতঃপর যারা অকৃতজ্ঞ হবে তারাতো সত্যত্যাগী।(সূরা নুর:৫৫)


আমি আয়াতের যতগুলো তাফসীর পড়েছি সবচাইতে বিস্তারিত ও সুন্দরভাবে তাফসীর করেছেন ইবনে কাছির।(১)


আর আমি একটি হাদিস দেখিয়েছি যেখানে বোঝা যায়, ১২ ইমামের মধ্যে ৪ জন হলো এই খোলাফায়ে রাশিদাগণ।৩০ বছর পর এই খেলাফত ধ্বংশ হয়ে যায়(২)।তাই ৪ জন এর মধ্যে শামিল।আর আমরা জানি যে ৪ জন খলিফা কোরাইশ বংশের ই।হাসান(রা:) যেহুতু  ৬ মাস অব্দি শাসণ করেছেন এবং উনি সহ ৩০ বছর পূর্ণ হয়,তাই উনিও সেই ১২ খলিফার মধ্যে পড়েছেন।তবে উমাইয়ারা যে রাজত্ব করেছেন তারা যেহুতু ভালো শাসক  নয় এবং নবিজীর সুন্নাহ মোতাবেক নয় তাই তারা গন্য হবে না।এটাও হাদিসেই আছে।(২)


"সাঈদ (রাঃ) বললেন, আমি তাকে বললাম বানু উমাইয়ার জনগণ ও দাবি করে যে, তাদের মাঝে ও খেলাফাত বিদ্যমান? তিনি বললেন যারকার সন্তানেরা মিথ্যা বলছে, বরং তারা তো নিকৃষ্ট রাজতন্ত্রের অন্তর্ভুক্ত রাজতান্ত্রিক গোষ্ঠী।"


শুধু তাই না,অনেক উমাইয়ারা আলী(রা:) কে খলিফা পর্যন্ত মনে করত না।


"সাঈদ (রহঃ) বলেন, আমি সাফীনাহ (রাঃ) - কে বললাম, এরা ধারণা করে যে, 'আলী (রাঃ) খলীফাহ ছিলেন না। তিনি বলেন, বর্নী যারকা অর্থাৎ মাওয়ানের বংশধরগণ মিথ্যা বলেছে"।


আহলে সুন্নাতের মত হলো,কিয়ামতের আগ পর্যন্ত মাঝেমধ্যে নবীর বলা সেই ইমামগণ আসতে থাকবে।যারা হবেন নেককার শাসক।সবাই হবেন কুরাইশ গোত্রের।আর পরিশেষে আসবেন ইমাম মাহদি(৩)।অর্থাৎ, সেই ১২ ইমামগগণ যে নবিজী(সা:) এর বংশধর ই হতে হবে এমন হওয়া বাধ্যতামূলক নয়।এটাই হলো আহলে সুন্নাতের রায়।


(১)সূরা নুর:৫৫ এর তাফসীর:-


আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা'আলা স্বীয় রাসূল (সঃ)-এর সাথে ওয়াদা করছেন যে, তিনি তাঁর উম্মতকে যমীনের মালিক বানিয়ে দিবেন, তাদেরকে তিনি লোকদের নেতা করবেন এবং দেশ তাদের দ্বারা জনবসতিপূর্ণ হবে। আল্লাহর বান্দারা তাদের প্রতি সন্তুষ্ট থাকবে। আজ জনগণ লোকদের থেকে ভীত-সন্ত্রস্ত রয়েছে, কাল তারা পূর্ণ নিরাপত্তা লাভ করবে। হুকুমত তাদের হবে এবং তারাই হবে সাম্রাজ্যের মালিক। সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর যে, হয়েছেও তাই। মক্কা, খায়বার, বাহরাইন, আরব উপদ্বীপ এবং ইয়ামন তো রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর যুগেই বিজিত হয়েছিল। হিজরের মাজুসীরা জিযিয়া কর দিতে স্বীকৃত হয়ে মুসলমানদের অধীনতা স্বীকার করে নেয়। সিরিয়ার কোন কোন অংশেরও এই অবস্থাই হয়। রোমক সম্রাট কায়সার উপহার উপঢৌকন পাঠিয়ে দেন। মিসরের গভর্নরও রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর খিদমতে উপঢৌকন পাঠায়। ইসকানদারিয়ার বাদশাহ মাকুকাস এবং আম্মানের বাদশাহরাও এটাই করেন এবং এইভাবে নিজেদের আনুগত্য প্রমাণ করেন। হাবশের বাদশাহ নাজ্জাসী (রঃ) তো মুসলমানই হয়ে যান যিনি আসহামার পরে হাবশের বাদশাহ হয়েছিলেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সঃ) যখন ইন্তেকাল করেন এবং হযরত আবু বকর (রাঃ) খিলাফতের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন তখন তিনি হযরত খালিদ ইবনে ওয়ালীদ (রাঃ)-এর নেতৃত্বে এক সেনাবাহিনী পারস্য অভিমুখে প্রেরণ করেন। সেখানে তিনি ক্রমান্বয়ে বিজয় লাভ করতে থাকেন এবং কুফরীর গাছগুলোকে কেটে ফেলে চতুর্দিকে ইসলামের চারা রোপণ করেন। হযরত আবু উবাদাহ ইবনে জাররাহ (রাঃ) প্রমুখ সেনাবাহিনীর অধীনে ইসলামের বীর সৈনিকদেরকে সিরিয়ার রাজ্যগুলোর দিকে প্রেরণ করেন এবং তাঁরা সেখানে মুহাম্মাদ (সঃ) পতাকা উত্তোলন করেন এবং ক্রুশ চিহ্নযুক্ত পতাকাগুলোকে উল্টোমুখে নিক্ষেপ করেন। হযরত আমর ইবনুল আস (রাঃ)-এর নেতৃত্বে একদল সেনাবাহিনী মিসরের দিকে প্রেরিত হয়। বসরা, দামে, আম্মান প্রভৃতি রাজ্য বিজয়ের পর হযরত আবু বকর (রাঃ) মৃত্যুর ডাকে সাড়া দেন। মৃত্যুর পূর্বে তিনি মহান। আল্লাহর ইঙ্গিতক্রমে হযরত উমার (রাঃ)-কে তাঁর স্থলাভিষিক্ত করে যান। এটা সত্য কথা যে, আকাশের নীচে কোন নবীর পরে হযরত উমার (রাঃ)-এর যুগের মত যুগ আর আসেনি। তার স্বভাবগত শক্তি, তাঁর পুণ্য, তার চরিত্র, তাঁর ন্যায়পরায়ণতা এবং তার আল্লাহভীতির দৃষ্টান্ত দুনিয়ায় তার পরে অনুসন্ধান করা বৃথা কালক্ষেপণ ছাড়া কিছুই নয়। সমগ্র সিরিয়া ও মিসর এবং পারস্যের অধিকাংশ অঞ্চল তার খিলাফতের আমলে বিজিত হয়। পারস্য সম্রাট কিসরার সাম্রাজ্য ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। স্বয়ং সম্রাটের মাথা লুকাবার কোন জায়গা থাকে। তাকে লাঞ্ছিত অবস্থায় পালিয়ে বেড়াতে হয়। রোমক সম্রাট কায়সারকেও সাম্রাজ্যচ্যুত করা হয়। সিরিয়া সাম্রাজ্য তার হাত ছাড়া হয়ে যায় এবং কনস্টান্টিনোপলে পালিয়ে গিয়ে তাকে আত্মগোপন করতে হয়। এই সাম্রাজ্যগুলোর বহু বছরের সঞ্চিত ধন-সম্পদ মুসলমানদের হস্তগত হয়। আল্লাহর এই সৎ ও মধুর চরিত্রের অধিকারী বান্দাদের মধ্যে এগুলো বন্টন করা হয়। এইভাবে মহান আল্লাহ তাঁর ঐ ওয়াদা পূর্ণ করেন যা তিনি তার প্রিয় বন্ধু হযরত মুহাম্মাদ (সঃ)-এর সাথে করেছিলেন। অতঃপর হযরত উসমান (রাঃ)-এর খিলাফতের যুগ আসে এবং পূর্ব হতে পশ্চিম প্রান্ত পর্যন্ত আল্লাহর দ্বীন ছড়িয়ে পড়ে। আল্লাহর সেনাবাহিনী একদিকে পূর্ব দিকের শেষ প্রান্ত এবং অপরদিকে পশ্চিম দিকের শেষ প্রান্তে পৌঁছে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন। ইসলামী মুজাহিদদের উন্মুক্ত তরবারী আল্লাহর তাওহীদকে দুনিয়ার প্রান্তে প্রান্তে পৌঁছিয়ে দেন। স্পেন, কিবরাস এমন কি সুদূর চীন পর্যন্ত হযরত উমার (রাঃ)-এর যুগে বিজিত হয়। পারস্য সম্রাট কিসরা নিহত হয়। তার সাম্রাজ্যের নাম ও নিশানা নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয়। অগ্নি উপাসকদের হাজার হাজার বছরের উপাসনালয় নির্বাপিত হয় এবং প্রত্যেকটি উঁচু টিলা হতে আল্লাহু আকবার ধ্বনি গুঞ্জরিত হয়। অপরদিকে মাদায়েন, ইরাক, খখারাসান, আহওয়ায ইত্যাদি সাম্রাজ্য জয় করা হয়। তুর্কীদের সাথে বিশাল যুদ্ধ সংঘটিত হয়। অবশেষে তাদের বড় বাদশাহ খাকান মাটির সাথে মিশে যায়। সে চরমভাবে লাঞ্ছিত ও পর্যদস্ত হয় এবং যমীনের পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্ত হতে হযরত উসমান (রাঃ)-এর দরবারে খাজনা পৌছতে থাকে। সত্য কথা তো এটাই যে, মুসলিম বীর পুরুষদের এই জীবন মরণ সংগ্রামের মূলে ছিল হযরত উসমান (রাঃ)-এর তিলাওয়াতে কুরআনের বরকত। কুরআন কারীমের প্রতি তাঁর যে আসক্তি ও অনুরাগ ছিল তা বর্ণনাতীত। কুরআনকে একত্রিতকরণ ও মুখস্থকরণ এবং প্রচার ও প্রসারকরণে তিনি যে খিদমত আঞ্জাম দেন তার তুলনা মিলে না। তাঁর যুগের থতি লক্ষ্য করলে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর ভবিষ্যদ্বাণীটি মানসপটে ভেসে ওঠে। তিনি বলেছিলেনঃ “আমার জন্যে যমীনকে এক জায়গায় একত্রিত ও জড় করা য়, এমনকি আমি পূর্ব দিক ও পশ্চিম দিক দেখে নিই। আমার উম্মতের সাম্রাজ্য ইন পর্যন্ত পৌঁছে যাবে যেখান পর্যন্ত আমাকে দেখানো হয়েছিল। এখন আৰা দেখতে পাই যে, আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (সঃ) আমাদের সাথে যে ভদ করেছিলেন তা সত্যে পরিণত হয়েছে। সুতরাং আমরা আল্লাহর প্রতি এবং তৰ ৰাসূল (সঃ)-এর প্রতি ঈমানের প্রার্থনা করছি এবং যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশে তিনি সন্তুষ্ট হন সেই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার আমরা তাঁর কাছে তাওফীক চাচ্ছি। হযরত জাবির ইবনে সামুরা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে বলতে শুনেছি- “মুসলমানদের কাজ উত্তমরূপে চালু থাকবে, শেষ পর্যন্ত তাদের মধ্যে বারো জন খলীফা হবে।” অতঃপর তিনি একটি বাক্য আস্তে বলেন যা আমার কর্ণগোচর হয়নি। আমি ওটা আমার পিতাকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) যে কথাটি আস্তে বলেছিলেন তাহলোঃ “এদের সবাই কুরায়েশী হবে।” (এ হাদীসটি ইমাম মুসলিম (রঃ) স্বীয় সহীহ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন) রাসূলুল্লাহ (সঃ) একথাটি ঐদিনের সন্ধ্যায় বলেছিলেন যেই দিন হযরত মায়েয ইবনে মালিক (রাঃ)-কে রজম বা প্রস্তরাঘাতে হত্যা করা হয়েছিল। সুতরাং জানা গেল যে, এই বারোজন খলীফা অবশ্যই হবেন। কিন্তু এটা স্মরণ রাখার বিষয় যে, এই বারো জন খলীফা তারা নয় যাদেরকে শিয়া সম্প্রদায় ধারণা করছে। কেননা শিয়াদের ইমামদের মধ্যে এমন বহু ইমামও রয়েছে যারা খিলাফত ও সালতানাতের কোন অংশ সারা জীবনেও লাভ করেনি। এই বারো জন খলীফা সবাই হবেন কুরায়েশ বংশের। তাঁরা হবেন ন্যায়ের সাথে ফায়সালাকারী। তাঁদের সুসংবাদ পূর্ববর্তী কিতাবসমূহেও রয়েছে। এটা শর্ত নয় যে, এই বারো জন খলীফা পর্যায়ক্রমে ও ক্রমিকভাবে হবেন। বরং হতে পারে যে, তারা বিভিন্ন যুগে হবেন। চার জন খলীফা তো ক্রমিকভাবেই হয়েছেন। যেমন হযরত আবু বকর (রাঃ), হযরত উমার (রাঃ), হযরত উসমান (রাঃ) এবং হযরত আলী (রাঃ)। তাঁদের পর ক্রম কেটে গেছে। পরে এরূপ খলীফা গত হয়েছেন এবং পরবর্তীতেও কোন কোন খলীফার আগমন ঘটতে পারে। সঠিক যুগের অবগতি একমাত্র মহান আল্লাহরই রয়েছে। তবে এটা নিশ্চিত কথা যে, ইমাম মেহেদীও এই বারো জনের একজন হবেন যার নাম ও কুনিয়াত হবে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নাম ও কুনিয়াত মুতাবেক। তিনি সমগ্র ভূ-পৃষ্ঠকে আদল ও ইনসাফ দ্বারা পূর্ণ করে দিবেন, যখন সারা দুনিয়া অন্যায় ও অত্যাচারে ছেয়ে যাবে। রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর মুক্ত দাস হযরত সাফীনা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আমার (ইন্তেকালের) পরে ত্রিশ বছর পর্যন্ত খিলাফত থাকবে, তারপর দন্তকর্তিত রাজ্য হয়ে যাবে।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ), ইমাম আবু দাউদ (রঃ), ইমাম তিরমিযী (রঃ) এবং ইমাম নাসাঈ (রঃ) বর্ণনা করেছেন) আবুল আলিয়া (রঃ) আয়াতের তাফসীরে বলেন যে, (ইসলামের আবির্ভাবের পর) রাসূলুল্লাহ (সঃ) এবং তাঁর সহচরবর্গ দশ বছরের মত মক্কায় অবস্থান করেন। ঐ সময় তারা দুনিয়াবাসীকে আল্লাহর একত্ববাদ ও তাঁর ইবাদতের দিকে আহ্বান করতে থাকেন। কিন্তু ঐ যুগটি ছিল গোপনীয়তা, ভয় ও নিরাপত্তাহীনতার যুগ। তখন পর্যন্ত জিহাদের হুকুম নাযিল হয়নি। মুসলমানরা ছিলেন অত্যন্ত দুর্বল। এরপর হিজরতের হুকুম হয় এবং তাঁরা মদীনায় হিজরত করেন। অতঃপর জিহাদের হুকুম অবতীর্ণ হয়। চতুর্দিকে শত্রু পরিবেষ্টিত ছিল। মুসলমানরা ছিলেন ভীত-সন্ত্রস্ত। কোন সময়ই বিপদ শূন্য ছিল না। সকাল সন্ধ্যায় সাহাবীগণ (রাঃ) অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত থাকতেন। একজন সাহাবী একদা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে বলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমাদের জীবনের একটা মুহূর্তও কি শান্তিতে কাটবে না? হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! ক্ষণেকের জন্যেও কি আমরা অস্ত্র-শস্ত্র রেখে দিয়ে তৃপ্তি ও স্বস্তির শ্বাস গ্রহণ করতে পারবো না?” রাসূলুল্লাহ (সঃ) অত্যন্ত শান্তভাবে উত্তর দেনঃ “আরো কিছুদিন ধৈর্যধারণ কর। অতঃপর এমন শান্তি এবং নিরাপত্তা বিরাজ করবে যে, মানুষ ভরা মজলিসে আরামে ও নিশ্চিন্তে বসে থাকবে, একজনের কাছে কেন, কারো কাছেই কোন অস্ত্র থাকবে।" ঐ সময় আল্লাহ তা'আলা এই আয়াত অবতীর্ণ করেন। অতঃপর আল্লাহর নবী (সঃ) আরব উপদ্বীপের উপর বিজয় লাভ করেন। আরবে কোন কাফির থাকলো না। সুতরাং মুসলমানদের অন্তর ভয়শূন্য হয়ে গেল। আর সদা-সর্বদা অস্ত্রে-শস্ত্রে সজ্জিত থাকার কোন প্রয়োজন থাকলো না। ভারপর রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর ইন্তেকালের পরেও তিনজন খলীফার যুগ পর্যন্ত সর্বত্র ঐ শান্তি ও নিরাপত্তাই বিরাজ করে। অর্থাৎ হযরত আবু বকর (রাঃ), হযরত উমার (রাঃ) এবং হযরত উসমান (রাঃ)-এর যুগ পর্যন্ত। এরপর মুসলমানদের মধ্যে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। কাজেই আবার তাদের মধ্যে ভয় এসে পড়ে এবং প্রহরী, চৌকিদার, দারোগা ইত্যাতি নিযুক্ত করতে হয়। মুসলমানরা যখন নিজেদের অবস্থা নিজেরাই পরিবর্তন করে তখন তাদের অবস্থা পবির্তিত হয়ে যায়। পূর্ব যুগীয় কোন কোন গুরুজন হতে বর্ণিত আছে যে, তারা হযরত আবু বকর (রাঃ) ও হযরত উমার (রাঃ)-এর খিলাফতের সত্যতার ব্যাপারে এই আয়াতটিকে পেশ করেছেন। হযরত বারা ইবনে আযিব (রাঃ) বলেনঃ “যখন এই আয়াত অবতীর্ণ হয় তখন আমরা অত্যন্ত ভয় ও দুর্ভাবনার অবস্থায় ছিলাম। যেমন আল্লাহ তা'আলা (আরবি) অর্থাৎ “তোমরা স্মরণ কর, যখন তোমরা ছিলে খুবই অল্প এবং ভূ-পৃষ্ঠে তোমাদেরকে দুর্বল মনে করা হতো।” (৮:২৬) অর্থাৎ পদে পদে তোমরা ভীত ও শংকিত থাকতে। অতঃপর আল্লাহ তোমাদের সংখ্যা বাড়িয়ে দেন এবং তোমাদেরকে শক্তিশালী করেন। আর তিনি তোমাদেরকে নিরাপত্তা দান করেন। মহান আল্লাহ বলেনঃ যেমন তিনি প্রতিনিধিত্ব দান করেছিলেন তাদের পূর্ববর্তীদেরকে। যেমন হযরত মূসা (আঃ) তাঁর কওমকে বলেছিলেন (আরবি) অর্থাৎ “এটা খুবই নিকটে যে, তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের শত্রুদেরকে ধ্বংস করবেন এবং যমীনে তোমাদেরকে তাদের স্থলাভিষিক্ত করবেন।” (৭:১২৯) অন্য আয়াতে বলেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “আমি চাই যে, ভূ-পৃষ্ঠে যাদেরকে দুর্বল জ্ঞান করা হতো তাদের প্রতি অনুগ্রহ করবো।” (২৮: ৫) এরপর মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ তিনি অবশ্যই তাদের জন্যে সুদৃঢ় করবেন তাদের দ্বীনকে যা তিনি তাদের জন্যে মনোনীত করেছেন এবং তাদের ভয়-ভীতির পরিবর্তে তাদেরকে অবশ্যই নিরাপত্তা দান করবেন। হযরত আদী ইবনে হাতিম (রাঃ) যখন প্রতিনিধি হিসেবে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট আগমন করেন তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাকে জিজ্ঞেস করেনঃ “তুমি কি হীরা নামক দেশ দেখেছো?” উত্তরে হযরত আদী ইবনে হাতিম (রাঃ) বলেনঃ “জ্বী না, আমি হীরা দেখিনি, তবে নাম শুনেছি।” তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “যার হাতে আমার প্রাণ রয়েছে তাঁর শপথ! আল্লাহ তা'আলা আমার এই দ্বীনকে পূর্ণরূপে ছড়িয়ে দিবেন। তখন এমনভাবে শান্তি ও নিরাপত্তা এসে যাবে যে, হীরা হতে একজন মহিলা উন্ত্রীর উপর সওয়ার হয়ে একাই বেরিয়ে পড়বে এবং বায়তুল্লাহ শরীফে পৌঁছে তাওয়াফ কার্য সম্পন্ন করতঃ ফিরে আসবে। সে না কাউকেও ভয় করবে এবং না কারো আশ্রয়ে থাকবে। জেনে রেখো যে, ইরানের বাদশাহ কিসরা ইবনে হরমুযের কোষাগার বিজিত হবে।” হযরত আদী (রাঃ) বিস্ময়ের সুরে বলেনঃ “ইরানের বাদশাহ কিসরা ইবনে হরমুযের কোষাগার মুসলমানরা জয় করবেন!” উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “হ্যাঁ, কিসরা ইবনে হরমুযের কোষাগারই বটে। ধন-সম্পদ এতো বৃদ্ধি পাবে যে, তা গ্রহণকারী কেউ থাকবে না।” হযরত আদী (রাঃ) বলেনঃ “দেখুন, বাস্তবিকই স্ত্রীলোকেরা হীরা হতে কারো আশ্রয় ছাড়াই যাতায়াত করছে। রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর এ ভবিষ্যদ্বাণী পূর্ণ হতে আমি স্বচক্ষে দেখলাম। দ্বিতীয় ভবিষ্যদ্বাণীও আমার চোখের সামনে পুরো হয়েছে। কিসরার ধনভাণ্ডার জয়কারীদের মধ্যে স্বয়ং আমিও বিদ্যমান ছিলাম। তৃতীয় ভবিষ্যদ্বাণীটিও নিঃসন্দেহে পূর্ণ হবে। কেননা, এটাও রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এরই ভবিষ্যদ্বাণী ।” হযরত উবাই ইবনে কা'ব (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “এই উম্মতকে ভূ-পৃষ্ঠে উন্নতি, উচ্চ মর্যাদা, দ্বীনের প্রসার ও সাহায্যের সুসংবাদ দিয়ে দাও। তবে যে ব্যক্তি দুনিয়া লাভের উদ্দেশ্যে আখিরাতের কাজ করবে তার জানা উচিত যে, পরকালে তার জন্যে কোনই অংশ নেই।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন) মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ তারা আমার ইবাদত করবে এবং আমার সাথে অন্য কাউকেও শরীক করবে না। হযরত মুআয ইবনে জাবাল (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা আমি উটের উপরে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর পিছনে বসেছিলাম। আমার ও তার মাঝে জিনের (উটের গদীর) শেষ কাষ্ঠখণ্ড ছাড়া কিছুই ছিল না (অর্থাৎ আমি নবী (সঃ)-এর খুবই সংলগ্ন ছিলাম)। তখন তিনি বললেনঃ “হে মুআয (রাঃ)!” আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! লাব্বায়েক ওয়া সাদায়েক! অতঃপর আল্লাহর রাসূল (সঃ) সামনে কিছুক্ষণ অগ্রসর হলেন। আবার তিনি বললেনঃ “হে মুআয (রাঃ)!” আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! লাব্বায়েক ওয়া সাদায়েক! আবার তিনি কিছুক্ষণ সামনে চললেন। পুনরায় তিনি বললেনঃ “হে মুআয (রাঃ)!" আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! লাব্বায়েক ওয়া সাদায়েক! তিনি (এবার) বললেনঃ “বান্দার উপর আল্লাহর হক কি তা কি তুমি জান?" আমি বললাম, আল্লাহ ও তার রাসূল (সঃ) অধিকতর ভাল জানেন ও জ্ঞাত আছেন। তিনি বললেনঃ “বান্দার উপর আল্লাহর হক এই যে, তারা একবার তারই ইবাদত করবে এবং তার সাথে এতটুকুও শরীক করবে না।” অতঃ তিনি কিছুক্ষণ সামনে গেলেন এবং আবার বললেনঃ “হে মুআয! (৯)!” আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! লাব্বায়েক ওয়া সাদায়েক! তিনি বললেনঃ “আল্লাহর উপর বান্দার হক কি তা তুমি জান কি?” আমি বললাম, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সঃ) সবচেয়ে ভাল জ্ঞাত আছেন। তিনি বললেনঃ “আল্লাহর উপর বান্দার হক হচ্ছে এই যে, তিনি তাদেরকে শাস্তি প্রদান করবেন না। (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন এবং ইমাম বুখারী (রঃ) ও ইমাম মুসলিম (রঃ) তাদের সহীহ গ্রন্থে এটা তাখরীজ করেছেন) অতঃপর আল্লাহ তাআলা বলেনঃ আর যারা অকৃতজ্ঞ হবে তারা তো সত্যত্যাগী অর্থাৎ এর পরেও যারা আমার আনুগত্য পরিত্যাগ করবে সে আমার হুকুম অমান্য করলো এবং এটা খুবই কঠিন ও বড় পাপ। আল্লাহর মাহাত্ম্য এই যে, যেই যুগে ইসলামের শক্তি বেশী থেকেছে সেই যুগে তিনি সাহায্যও বেশী করেছেন। সাহাবীগণ ঈমানে অগ্রগামী ছিলেন, কাজেই তঁারা বিজয় লাভের ব্যাপারেও সবারই অগ্রে থেকেছেন। যেমন ঈমানে দুর্বলতা দেখা দেয় তেমন পার্থিব অবস্থা, রাজত্ব এবং শান-শওকতও নীচে নেমে গেছে। সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আমার উম্মতের মধ্যে একটি দল সদা সত্যের উপর থাকবে এবং তারা থাকবে সদা জয়যুক্ত। তাদের বিরোধীরা তাদের কোনই ক্ষতি করতে পারবে না। কিয়ামত পর্যন্ত এই অবস্থাই থাকবে। আর একটি রিওয়াইয়াতে আছে যে, শেষ পর্যন্ত আল্লাহর ওয়াদা এসে যাবে। একটি বর্ণনায় রয়েছে যে, শেষ পর্যন্ত এই দলটিই সর্বশেষে দাজ্জালের সাথে যুদ্ধ করবে। আর একটি হাদীসে আছে যে, হযরত ঈসা (আঃ)-এর অবতরণ পর্যন্ত এই লোকগুলো কাফিরদের উপর জয়যুক্ত থাকবে। এই সব রিওয়াইয়াত বিশুদ্ধ এবং সবগুলোরই ভাবার্থ একই।


(২)সাঈদ ইবনু জুহমান (রহঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, সাফিনাহ (রাঃ) আমার নিকট বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ আমার উম্মতের খিলাফাতের সময়কাল (শাসনকাল ) হবে ত্রিশবছর, তারপর হবে রাজতন্ত্র। তারপর সাফিনাহ (রাঃ) আমাকে বললেন, তুমি আবূ বকর (রাঃ) এর খিলাফতকাল গণনা কর। তারপর বললেন, উমার ও উসমান (রাঃ)-এর খিলাফতকাল গণনা কর। তারপর বললেন, আলী (রাঃ)-এর খিলাফতকালও গণনা কর। আমরা গণনা করে এর সময়কাল ত্রিশবছরই পেলাম। সাঈদ (রাঃ) বললেন, আমি তাকে বললাম বানু উমাইয়ার জনগণ ও দাবি করে যে, তাদের মাঝে ও খেলাফাত বিদ্যমান? তিনি বললেন যারকার সন্তানেরা মিথ্যা বলছে, বরং তারা তো নিকৃষ্ট রাজতন্ত্রের অন্তর্ভুক্ত রাজতান্ত্রিক গোষ্ঠী।

 মুসনাদে আহমাদের বর্ণনায়ঃ নু'মান বিন বশীর (র) আল্লাহর নবী (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর গোপন বিষয়ের জ্ঞানধারণকারী হুযাইফা(র) হতে বর্ণনা করেন, আমি আল্লাহর নবী (সাল্লাল্লাহু "আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হতে শাসকদের সম্পর্কে হাদিস মুখস্থ রেখেছি। তিনি বলেন: “নবুওয়্যাত তোমাদের মাঝে থাকবে, যতদিন মহান আল্লাহ চান, এরপর তিনি তা উঠিয়ে নেবেন যখন তিনি চান। অতপর, নবুওয়্যাতের আদলে খিলাফাহ আসবে এবং তা বিদ্যমান থাকবে যতদিন তিনি চান এবং তিনি উঠিয়ে নেবেন যখন তিনি চান। অতঃপর আসবে উত্তরাধিকার সূত্রে রাজতন্ত্র এবং তা থাকবে যতদিন মহান আল্লাহ চান এবং তিনি তা উঠিয়ে নেবেন যখন চান। অতঃপর আসবে চরম জবরদস্তির শাসন, যা থাকবে যতদিন মহান আল্লাহ চান এবং যখন তিনি চান, তা উঠিয়ে নেবেন। অতঃপর আসবে নবুওয়াতে আদলে খিলাফাহ। এর পর তিনি চুপ হয়ে গেলেন। তিরমিজীর বর্ণনায়ঃ সাফীনাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহ "আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ নবুওয়্যাতের ভিত্তিতে পরিচালিত খিলাফত ত্রিশ বছর অব্যাহত থাকবে। অতঃপর আল্লাহর যাকে ইচ্ছা রাজত্ব বা তাঁর রাজত্ব দান করবেন। সাঈদ (রহঃ) বলেন, আমাকে সাকীনাহ (রাঃ) বলেছেন, হিসেব করো, আবূ বকর (রাঃ) দুই বছর, "উমার (রাঃ) দশ বছর, উসমান (রাঃ) বারো বছর ও আলী (রাঃ) এতো বছর খিলাফতের দায়িত্ব পালন করেছেন। সাঈদ (রহঃ) বলেন, আমি সাফীনাহ (রাঃ) - কে বললাম, এরা ধারণা করে যে, 'আলী (রাঃ) খলীফাহ ছিলেন না। তিনি বলেন, বর্নী যারকা অর্থাৎ মাওয়ানের বংশধরগণ মিথ্যা বলেছে। [আবু দাউদ: ৪৬৪৬, জামে আত-তিরমিজি, মুসনাদে আহমাদ ১৮৪৩০ (৪র্থ খন্ড, পৃষ্ঠা ২৭৩): ২২২৬, মিশকাতুল মাসাবিহ ৫৩৭৮, শায়খ যুবাইর আলি যাই এবং শায়খ শুআইব আরনাউৎ বলেন: এর সনদ সহীহ]


৩)জাবির (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: আমার উম্মতের একদল লোক সত্যের উপর দৃঢ় থেকে (বাতিলের বিরুদ্ধে বিজয়ীরূপে কিয়ামত পর্যন্ত যুদ্ধ করতে থাকবে। তিনি (সা.) বলেন, অতঃপর 'ঈসা ইবনু মারইয়াম (আঃ) অবতরণ করবেন। সে সময়ের লোকেদের আমীর বা নেতা (ইমাম মাহদী) তাকে বলবেন, আপনি এদিকে আসুন এবং লোকদেরকে সালাত আদায় করিয়ে দিন। তিনি বলবেন না; বরং তোমরা একে অপরের ইমাম। আল্লাহ তা'আলা এ উম্মাতকে মর্যাদা দান করেছেন। (মুসলিম)।


সহীহ: মুসলিম ১৫৬ ,মিশকাতুল মাসাবিহ:৫৫০৭,মুসনাদে আহমাদ ২৪৮৪, আবু দাউদ ২২৪৫, সহীহুল জামি ৭২৯৩, সিলসিলাতুস্ সহীহাহ ১৯৬০, মুসনাদে আহমাদ ১৪৭৬২, সহীহ ইবনু হিব্বান ৬৮১৯, আল মু'জামুল কাবীর লিত্ব তবারানী ১৪৬৪৮, আল মু'জামুল আওসাত্ব ৯০৭৭, আল মুসতাদরাক লিল হাকিম ২৩৯২, আস্ সুনানুল কুবরা লিল বায়হাকী ১৮৩৪৯।

Comments

Popular posts from this blog

আজকের বিষয়:- খারেজ্বীদের উৎপত্তি এবং এর অন্তিম পরিণতি হযরত আলী(রা:) কে হত্যা

সিফফিনের যুদ্ধ।

আহলে বায়াতের মর্যাদা